সামনে নির্বাচন, আলোচনায় নানা ফর্মুলা আর কৌশল

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  দিন-মাস যত গড়াচ্ছে ততোই ঘনিয়ে আসছে একাদশ সংসদ নির্বাচন। সরকারের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে এই নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির নেতৃত্বাধীন জোট নানামুখী কৌশল আঁটছে। ‘একাদশ নির্বাচন পাঁচ জানুয়ারির মত হবে না, নির্বাচন কঠিন হবে’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বার্তাকে ধর্তব্যে নিয়ে মাঠে সক্রিয় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আবার এ সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতার আসনে ফিরতে মরিয়া বিএনপিসহ দলটির মিত্ররা। এই দুটি জোটের বাইরে থাকা জাতীয় পার্টি (জাপা) সহ অন্য নিবন্ধিত দলগুলোও বসে নেই। বিশেষ করে, পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনকারী ডান-বামপন্থী অন্য দলগুলো সমমনাদের নিয়ে পৃথক বলয় গড়তে তত্পর হয়ে উঠেছে। নির্বাচনি মাঠের খেলোড়ায় দলগুলোর এরকম নানা কৌশলের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গণসহ অন্দর মহলের ঘরোয়া আলোচনায় শোনা যাচ্ছে নানা ফর্মুলা বা তত্ত্বের কথা।

নির্বাচনকে ঘিরে নানা ‘ষড়যন্ত্রের’ শঙ্কা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অন্তত দুই মাসের সফরে গত ১৫ জুলাই লন্ডন যাওয়ার পর রাজনৈতিক বাহাসে নতুন করে যুক্ত হয় এই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’। খালেদা জিয়া লন্ডনে যাওয়ার একদিন পর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হতে পারে’। ষড়যন্ত্রে ভীত না হয়ে চোখ-কান খোলা রেখে নিজেদের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে তিনি দল-জোট নেতাদের পরামর্শ দেন। ওই মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরেও কমপক্ষে আরও দু’বার দুটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এই ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তখন থেকেই নির্বাচনকেন্দ্রিক নানা সমীকরণ তত্ত্ব ডালপালা মেলে। নির্বাচনকে ঘিরে একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর নানা কৌশল আর প্রস্তুতির মাঝেই সর্বত্র নতুন করে ভাবনার খোরাক যোগায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং এরসঙ্গে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ। রাজনীতির অলি-গলিসহ সাধারণ মানুষের আলোচনায় কান পাতলেও শোনা যায় আপিল বিভাগের এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে নানামুখী পর্যালোচনা আর বিশ্লেষণ।

নির্বাচনকে ঘিরে রাজনীতির মাঠে এরকম নানা কথাবার্তা আর জল্পনা-কল্পনার বিষয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন গতকাল হাওর বার্তাকে সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীনরা সবসময় বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে এরকম ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। তাছাড়া প্রতিটি নির্বাচনের আগেই কমবেশি নানা তত্ত্ব বা ফর্মুলার কথা আমরা শুনতে পাই, যেগুলোর বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত গুজবেই পরিণত হয়, আবার কখনও কখনও বাস্তবেও আমরা সেটির প্রতিফলন দেখেছি। তিনি বলেন, তবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে রাজনীতির এসব ভিন্ন তত্ত্বের সম্পর্ক নেই। আদালতের কাজ আদালত করেছে, এনিয়ে কারও প্রশ্ন তোলা সমীচীন নয়।

এদিকে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে খোলাসা না করলেও ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি আদায়ে আন্দোলনসহ নানা কৌশল গ্রহণের পাশাপাশি নির্বাচনে দলের ও জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকাও যাচাই-বাছাই করছে বিএনপি। দাবি না মানলেও সরকার যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মত আরেকটি নির্বাচন করে ফেলতে না পারে, সেজন্য সম্ভাব্য সব ধরনের কৌশল প্রণয়নে ব্যস্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাওর বার্তাকে সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য অত্যন্ত পরিস্কার, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে।’ সঙ্গে তিনি এটিও পুনর্ব্যক্ত করলেন যে, শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না, এমনকি বিএনপিকে বাইরে রেখে পাঁচ জানুয়ারির মত আরেকটি নির্বাচনও সরকারকে করতে দেয়া হবে না।

খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করবেন, বিএনপির পক্ষ থেকে একথা বলার মধ্যেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও আদালতের পর্যবেক্ষণের পর দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আদালতের এই রায় ও পর্যবেক্ষণের পর এ সরকারের ক্ষমতায় থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই, সরকারের উচিত অবিলম্বে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়া।’

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চাইলে পারবেন না। অতীতেও  কেউ পারেনি। এখানে হাত দিলে হাত পুড়ে যায়।’

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘কেউ কেউ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় মহাখুশি। এরা এভাবেই খুশি হয়। এ ঘটনায় দুর্ঘটনার ইস্যু খুঁজে লাভ নাই। ভারতে নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় এলেন তখন সকালবেলা ফলাফলের আগেই ভারতীয় দূতাবাসে ফুল দিয়েছিল বিএনপি। আমেরিকায় নির্বাচনি ফলাফল বের হওয়ার আগে তাদের সুবাদে বাংলাদেশে ফুলের দোকান, মিষ্টির দোকান শূন্য হয়ে গিয়েছিল হিলারি ক্লিনটন ক্ষমতায় বসবেন বলে। তারা মনে করেছিল, হিলারি ক্ষমতায় এসে তাদের ক্ষমতায় বসাবে। কিন্তু ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ ছাড়া কাউকে কেউ ক্ষমতায় বসাতে পারে না।’

খালেদা জিয়া লন্ডনে বসে আগামী নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র করছেন বলেও সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, ‘উনি (খালেদা জিয়া) সেখানে কোনো ষড়যন্ত্র করছেন কিনা সে ব্যাপারে সরকার খোঁজ রাখছে।’ একই আশঙ্কা ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, ‘নতুন করে সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বিএনপি। আমরা আশঙ্কা করছি, লন্ডনে বসে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই বলছি, খালেদা জিয়ার দল নির্বাচনকে ভুল করা যায় কীভাবে সে চেষ্টা করছে।’

খালেদা জিয়ার লন্ডন সফর নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের এই অভিযোগের জবাবে  বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘চিকিত্সার জন্য বেগম খালেদা জিয়া লন্ডন যাবার পর সরকারের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা কতই না প্রলাপ বকছেন। প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতারা বললেন, খালেদা জিয়া মামলার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, এখন তারা বলছেন ষড়যন্ত্র করতেই লন্ডন গেছেন। এরপরে হয়ত তারা আরেক নতুন তত্ত্ব দেবেন।’

নির্বাচনি কৌশল প্রণয়নের পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ নিয়ে প্রধান দুই দলের নেতারা যখন বাহাস করছেন তখন রাজনৈতিক অঙ্গণে আলোচনায় যুক্ত হয় গত বুধবার বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বারিধারার বাসায় কয়েকটি দলের বৈঠক প্রসঙ্গ। আওয়ামী লীগ-বিএনপির জোটের বাইরে নতুন জোট গড়ার লক্ষ্যে ওই বৈঠকে আলোচনা শেষে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। ওই বৈঠকে যোগ দেয়া গণফোরাম নেতা এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী হাওর বার্তাকে বলেন, জোট গড়ার সঙ্গে সিপিবি-বাসদ ও বামমোর্চার সঙ্গে যুগপত্ কর্মসূচি পালন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আর মান্না বলেছেন, এ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আমরা রাস্তায় নামবো, একা কিছু করা সম্ভব নয়, তাই নিজেরা জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছি।

বি. চৌধুরীর বাড়িতে এই বৈঠক নিয়েও রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা রয়েছে। যেই আলোচনায় নতুন খোরাক যুগিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, তিনি বলেছেন ‘এবার রমজামে বি. চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর ইফতারে গেছেন, কাজেই বি. চৌধুরীকে মিত্রবাহিনীর সদস্য বলেই ধরে নেয়া যায়।’ ওই বৈঠকে এরশাদের ভাই ও জাপার কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের উপস্থিতি বিষয়টিকে আরও কৌতুহলী করে তুলেছে। এই বৈঠক ও তাতে জি এম কাদেরের উপস্থিতির সঙ্গেও রাজনৈতিক অঙ্গণে আলোচনায় থাকা নানা কৌশল বা তত্ত্বের যোগসূত্র মেলাচ্ছেন অনেকে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর